মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:২৭ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টারঃ যমুনা নদীতে গাইবান্ধার বালাশী ঘাট থেকে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার নৌরুট এবং দুই প্রান্তে টার্মিনাল তৈরির কাজ শেষ হয় ২০২১ সালের জুনে। পৌনে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প শেষে ফেরি চলাচলের কথা থাকলেও নাব্য সংকটে এক দিনও তা চলেনি। এর পর কিছুদিন লঞ্চ চললেও বন্ধ হয়ে যায়। অভিযোগ উঠেছে, যমুনার ওই স্থানে এত বড় নৌপথ চালু রাখা প্রায় অসম্ভব। এটি জানা সত্ত্বেও জনগণের টাকা লুটপাট করতে প্রকল্পটি নেওয়া হয়।
স্থানীয়রা জানান, যমুনার দুই পাড়ে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে ময়মনসিংহ এবং রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে এখানে একটি নৌরুট প্রয়োজন। ব্রিটিশ আমল থেকে গাইবান্ধার তিস্তামুখ-বাহাদুরাবাদ নৌপথ চালু ছিল। উত্তরাঞ্চল থেকে রাজধানীতে যাতায়াতে দু’পাশে ছিল রেললাইনও। চলাচল করত ফেরি। ১৯৯০ সালে নাব্য সংকটে তিস্তামুখঘাটটি স্থানান্তর হয় বালাশীতে। এর পর যমুনা বহুমুখী সেতু চালুর পর ২০০০ সাল থেকে ফেরি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এতে স্থানীয়দের যাতায়াতের পাশাপাশি সংকট বাড়ে পণ্য আনা-নেওয়ায়। কারণ, সড়কপথে যমুনা সেতু হয়ে এই দুই ঘাটের দূরত্ব ২৮৭ কিলোমিটার।
বিআইডব্লিউটিএর তথ্যমতে, উত্তরের ১৩ জেলার মধ্যে পণ্য সরবরাহ সহজ করতে এবং যমুনা সেতুতে যানবাহনের চাপ কমাতে ২০১৪ সালের দিকে এই নৌপথে ফের ফেরি চালুর সিদ্ধান্ত নেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। ২০১৪ সালের মার্চে তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া নৌপথটি পরিদর্শন করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর একনেকে পাস হয় বালাশী ও বাহাদুরাবাদে ফেরিঘাটসহ আনষুঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ প্রকল্প। এতে ড্রেজিং করে নৌপথ সচল এবং দুই প্রান্তে ফেরি টার্মিনাল ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। পরে কয়েক দফায় তা বাড়ালে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
তবে চরম ভুল করা হয় নৌপথ নির্ধারণে। বালাশী থেকে বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত প্রায় ২৬ কিলোমিটারের যে নৌপথ নির্ধারণ করা হয়, যমুনা নদীর এ অংশে কিছুদুর পরপরই আছে চর-ডুবোচর। এত বড় রুট নিয়মিত ড্রেজিং করেও নৌচলাচলের উপযোগী রাখা প্রায় অসম্ভব। অথচ বালাশীঘাট থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলারই সানন্দবাড়ী পর্যন্ত নৌপথের দূরত্ব ৯ থেকে ১০ কিলোমিটার। এখানে যমুনা বেশ প্রশস্তও। সানন্দবাড়ী থেকে ময়মনসিংহ ও ঢাকায় সড়ক যোগাযোগও রয়েছে। তবে এই পথ বাদ দিয়ে ২৬ কিলোমিটার নৌরুট চালুর সিদ্ধান্ত হয় মূলত লুটপাট করতেই।
বিআইডব্লিউটিএর এক প্রকল্প পরিচালকের কথায়ও এর প্রমাণ মেলে। নাম প্রকাশ না করা শর্তে তিনি বলেন, আসলে প্রকল্পের লক্ষ্য ভালো ছিল। তবে সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তির উদ্দেশ্য ভালো ছিল না। ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পথে নাব্য সংকট দেখা দেবে জানার পরও প্রকল্পটি নেওয়া হয়। অথচ বালাশীঘাট থেকে সানন্দবাড়ী পর্যন্ত নৌপথটি করলে দূরত্ব হতো ৯ থেকে ১০ কিলোমিটার। নদীর গতিপ্রকৃতি, ঠিকমতো সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া ব্যয় বাড়াতে বড় রুট নির্ধারণের কারণে এত কোটি টাকার প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে। লুটপাটের ধান্দা না করে নৌপথটি সানন্দবাড়ী পর্যন্ত করলে নাব্য সংকটও দেখা দিত না।
সংশ্লিষ্টদের সেই অসৎ উদ্দেশ্যের প্রমাণ পাওয়া যায় প্রকল্প শেষের আগ দিয়েই। ২০২১ সালে দুই নৌঘাটের ভৌত কাঠামো নির্মাণ প্রায় শেষে আকস্মিকভাবে বিআইডব্লিউটিএর কারিগরি কমিটি নাব্য সংকট ও ২৬ কিলোমিটার দূরত্বের সমস্যার কথা তুলে ধরে নৌপথটি ফেরি চলাচলের অনুপযোগী ঘোষণা করে। ওই বছরের এপ্রিলে সমস্যা খুঁজে দেখতে কমিটি করে সংস্থাটি। ভৌত কাজের গুণগতমান ও তদারকির অভাব, নাব্য সংকট, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতাসহ নানা দিক তুলে ধরে পথটি ফেরি চলাচলের অনুপযোগী বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সেই কমিটি। নদীর মরফোলজিক্যাল (রূপতত্ত্ব বা ভৌগোলিক অবস্থা ও গতি-প্রকৃতি) অবস্থা না জেনে ফেরিঘাট নির্মাণ করায় তা স্থানান্তর এবং অবকাঠামোগুলো অন্য কাজে ব্যবহারের সুপারিশ করে কমিটি।
এর পর ২০২২ সালের ৯ এপ্রিল নৌপথটি উদ্বোধন করতে যান তৎকালীন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। উদ্বোধনের দিনই নাব্য সংকট নিয়ে বিআইডব্লিউটি-এর প্রকৌশলীদের ওপর ক্ষোভও দেখান প্রতিমন্ত্রী। পরে প্রতিমন্ত্রীকে দিয়ে ফেরির বদলে লঞ্চ সার্ভিস উদ্বোধন করানো হয়। প্রথমে দুটি এবং পরে ছয়টি লঞ্চ চলাচলের ব্যবস্থা করা হলেও নাব্য সংকটে তাও কিছুদিন পর চলেনি। স্থানীয়দের অভিযোগ, ড্রেজিংয়ের সময় বালু দূরে না ফেলে নদীতেই ফেলা হয়। এ ছাড়া লোক দেখানো নামমাত্র ড্রেজিং করে অর্থ লুটপাট করায় নৌপথটিতে লঞ্চও চালানো যায়নি।
সরেজমিন উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের বালাশীঘাট এবং দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ফেরি টার্মিনালে দেখা যায়, আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন নৌ-টার্মিনাল জুড়ে সুনসান নীরবতা। পড়ে রয়েছে যাত্রীদের জন্য আধুনিক বাস টার্মিনাল, টোল আদায় বুথ, পুলিশ ব্যারাক, ফায়ার সার্ভিস, আধুনিক ডিজাইনের মসজিদ, রেস্তোরাঁ, আনসার ব্যারাকসহ সব স্থাপনা।
বাহাদুরাবাদঘাট যেতে বালাশী টার্মিনাল এলাকায় নৌকার জন্য অপেক্ষা করছিলেন আবুল হোসেন। তিনি বলেন, আমি ঢাকায় চাকরি করি। জামালপুরে শ্বশুরবাড়ি হয়ে ঢাকা যাব। আগে ফেরিতে নিরাপদে পারাপার হতাম। এখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় নদী পার হতে হয়।
বিআইডব্লিউটিএর এক কর্মকর্তা বলেন, ২৬ কিলোমিটারের এ নৌরুট বর্ষা মৌসুমেই পার হতে ৪-৫ ঘণ্টা সময় লাগে। শুষ্ক মৌসুমে পলিতে নৌযান আটকে যায়। এ জন্য লঞ্চ মালিকরা এ রুট ব্যবহারে আগ্রহী নন। স্টেকহোল্ডার অ্যানালাইসিস ও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করে প্রকল্পটির স্থান নির্ধারণ করায় পুরো টাকাটাই গচ্চা গেছে।
প্রকল্পটির স্থাপনা ও নদী খননের (ড্রেজিং) কাজ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসএস রহমান ইন্টারন্যাশনাল। ঢাকা থেকে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী রকিবুল ইসলাম দিপুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প ম্যানেজার (পিএম) বায়েজিদ হোসেন বলেন, দুই পাড়ে স্থাপনা নির্মাণের কাজগুলো আমি সরাসরি তদারকি করলেও ড্রেজিংয়ে যুক্ত ছিলেন বিআইডব্লিউটিএর ইঞ্জিনিয়াররা।