শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৫২ পূর্বাহ্ন

সুন্দরগঞ্জে কর্মক্ষেত্র ও পরিশ্রম দুটোই সমানঃ বৈষম্য মজুরীতে

সুন্দরগঞ্জে কর্মক্ষেত্র ও পরিশ্রম দুটোই সমানঃ বৈষম্য মজুরীতে

স্টাফ রিপোর্টারঃ বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। মাথায় সংসারের হাজারো চিন্তা, চোখে ক্লান্তি। কাঠ ফাটা রোদে সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর মজুরি পাবার অপেক্ষা করছিলেন তিনি। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে খানিকটা অভিযোগ ঝড়ে পড়লো তার কণ্ঠে। তিনি বললেন, ‘সারাদিন সমান তালে পুরুষদের সাথে কাজ করলাম। মজুরির বেলায় হামাক শেষে ফেলাইছে। সব জায়গায় হামারগুলার (নারীদের) কষ্ট। তিনি আরও বলেন, একই কাজের জন্য ওমরা (পুরুষরা) পায় ৪৫০ টাকা। শুধু নারী বলেই তাকে ১৫০ টাকা কম দেওয়া হয়। শুধু তাই নয় মাঝে মাঝে মজুরি পেতেও সমস্যা হয়। অনেক সময় বাকি থাকে। আবার কাজ না পেলে সংসারে নেমে আসে অন্ধকার। ছেলের পড়ালেখার খরচ তো দূরের কথা তখন থাকতে হয় আধ পেটে।
আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন মনজুয়া বেগম (৫০)। তিনি উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের ফলগাছা গ্রামের মৃত আনারুল ইসলামের স্ত্রী। ১৪ বছর আগে তাঁর স্বামী মারা যান। দুই সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াইটা শুরু হয় তার তখন থেকেই। বড় ছেলে এখন এইচএসসিতে। ছোট ছেলে কোরআনের হাফেজ হওয়ার পর দাখিল ক্লাশে অধ্যয়নরত আছে। ছেলে দুটো মানুষ না হওয়া পর্যন্ত এ সংগ্রাম চলবে বলেও জানান তিনি।
একদল নারী-পুরুষ দলবেঁধে কাজ করছিলেন পাট ক্ষেতে। সেখানে কথা হয় নারী শ্রমিক সেকেনভানুর সাথে (৫৫)। ঘরের রান্না শেষ করে সকাল ৭টার দিকে ঘর ছাড়তে হয়। ৮টায় গৃহস্থের বাড়ি পৌছাতে না পারলে কাজে নিবেন না তাকে। তাই ৮টার মধ্যে উপস্থিত হয়ে শুরু করেন কাজ। বিকেল ৫টায় কাজ শেষে মজুরি পান ৩০০ টাকা। ৯ ঘণ্টা একই কাজ করে একজন পুরুষ পান ৪৫০ টাকা। কর্মঘণ্টা, কাজের পরিমাণ ও ধরন এক হলেও ভিন্নতা শুধু মজুরির বেলায়। দীর্ঘদিন ধরে নারী শ্রমিকেরা এভাবে মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। দিনভর মাঠে পুড়েও পাচ্ছেন না তারা তাদের ন্যায্য মজুরি।
সেকেনভানু উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের ফলগাছা দর্জিপাড়া গ্রামের আঃ রাজ্জাক মিয়ার স্ত্রী। স্বামীর পায়ে সমস্যা থাকায় বিছানায় শয্যাশায়ি তিনি বছর তিনেক থেকে। সেই থেকে হাল ধরেছেন সংসারের। কোনো রকমে বিয়ে দিয়েছেন মেয়েদের। প্রতিবন্ধী এক ছেলে ও স্বামীর চিকিৎসা করতে হচ্ছে। দিন শেষে যা পাই তাতে ঔষধ কিনলে বাজার হয়না। আর বাজার করলে ঔষধ হয় না। কি আর করার।
দলের পুরুষ সহকর্মী রফিকুল ইসলাম বলেন, এক সাথে পাট ক্ষেতে এসেছে। আমরা যতক্ষন থাকবো মহিলারও ততক্ষণ থাকবেন। পরিশ্রমও সমান সমান। সবই ঠিক আছে কিন্তু আমরা পুরুষ আর তারা মহিলা। সে কারণেই মজুরি কমবেশি। এটা আগে থেকেই হয়ে আসছে। করার কিছু নেই।
নারী শ্রমিকদের অভিযোগ, কৃষি থেকে শুরু করে ইটভাটা, রাজ মিস্ত্রিসহ বিভিন্ন কাজ করেন তারা। কাজের ক্ষেত্রে সমতা থাকলেও নেই মজুরি সমতা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়ে নারী শ্রমিকদের ঠকতে হচ্ছে। মজুরি বৈষম্য রোধে উদ্যোগ নেই সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের। পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও নারী শ্রমিকরা কাঙ্খিত পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না এমন অভিযোগ অনেকের।
জানা গেছে, প্রায় ৮ লক্ষ লোকের বসবাস এ উপজেলায়। এর এক তৃয়াংশ মানুষ শ্রম বিক্রি করে সংসার চালান। যাদের দুই ভাগের এক ভাগই নারী শ্রমিক। সরকারি নানা উন্নয়নমুখী কর্মকান্ডসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণ থাকলেও পারিশ্রমিকের বেলায় পুরুষদের অর্ধেক মজুরিতে কাজ করতে হচ্ছে নারী শ্রমিকদের।
পিআই অফিস জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে উপজেলার ১৫ ইউনিয়নে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসূচি’ (ইজিপিপি) তে কাজ করছেন ৪ হাজার শ্রমিক। এ প্রকল্পের আওতায় নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের সমমর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তবে স্থানীয়ভাবে কাজ করতে গেলে নারী-পুরুষের মধ্যে মজরি বৈষম্য লক্ষ করা যায়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ-আল-মারুফ বলেন, শুধু সুন্দরগঞ্জেই নয়, সারাদেশেই নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ প্রশংসনীয়। প্রতিটি শ্রমিকের পারিশ্রমিকের ব্যাপারে সরকারি কর্মমজুরি বোর্ড রয়েছে। নারী শ্রমিকরা যেহেতু উন্নয়নের অংশিদার, সেহেতু তাদের ফাঁকি দেওয়া বা মজুরি কম দেওয়া অমানবিক। স্থানীয়দের বৈষম্য না করার অনুরোধ জানাই।

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

নিউজটি শেয়ান করুন

© All Rights Reserved © 2019
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com