বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৩১ অপরাহ্ন

গাইবান্ধায় যমুনা নদীর ভাঙন রোধ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মঃ কাজে ধীরগতিঃ বর্ষায় হাজার হাজার পরিবার গৃহহীন হওয়ার আশংকা

গাইবান্ধায় যমুনা নদীর ভাঙন রোধ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মঃ কাজে ধীরগতিঃ বর্ষায় হাজার হাজার পরিবার গৃহহীন হওয়ার আশংকা

স্টাফ রিপোর্টারঃ গাইবান্ধায় প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন যমুনা নদীর ভাঙন রোধ প্রকল্পের কাজে নানা অনিয়ম দুর্নীতি এবং ধীরগতির কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এর ভবিষ্যৎ। ঠিকাদারদের বার বার কারণ দর্শানোর নোটিশের মাধ্যমে তাগিদ দিয়েও প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অনিশ্চয়তা দূর করা যায়নি। অথচ চুক্তি মোতাবেক চলতি জুন মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিলো ঠিকাদারদের। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত এ প্রকল্পের ৪০% ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে আরও অনেক কম। এদিকে আসন্ন বর্ষায় সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসি প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় নদী ভাঙন আশংকায় উদ্বিগ্ন দিন কাটাচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার অব্যাহত ভাঙন থেকে বিপুল জনপদ এবং ফসলী জমি রক্ষাকল্পে ২০১৮ সালে ২৯৫ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পের আওতায় সদর উপজেলার বাগুড়িয়া থেকে শুরু করে ফুলছড়ি উপজেলার বালাসী, রতনপুর, সিংড়িয়া-কাতলামারী হয়ে গজারিয়ার গণ কবর পর্যন্ত এলাকায় ৪টি পয়েন্টে মোট সাড়ে ৪ কি.মি. অংশে সিসি ব্লক দ্বারা যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ কাজ করার কথা। এ কাজে ৪ ধরণের সিসি ব্লক ব্যবহার করা হবে। এরমধ্যে রয়েছে ৪০ ঘন সে.মি., ৪৫ ঘন সে.মি. ৩৫ ঘন সে.মি. এবং ৪০দ্ধ৪০দ্ধ২০ সে.মি. সাইজের ব্লক।
২০১৮ সালের জুন মাসে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকাভূক্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নারায়নগঞ্জের ডক ইয়ার্ড এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ লিঃ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানটি নিজে কাজ না করে ঢাকার ওয়েষ্টার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে এ কাজের সাব কনট্রাক দেয়। এ প্রকল্পের আওতায় সদর উপজেলার বাগুড়িয়া পয়েন্টে ৩শ’ মি., ফুলছড়ির বালাসী পয়েন্টে এক হাজার ৩শ’ মি., রতনপুর পয়েন্টে এক হাজার ৫শ’ মি., সিংড়িয়া-কাতলামারী পয়েন্টে ৭শ’ মি. এবং গজারিয়ার গণকবর পয়েন্টে ৭শ’ মি. অংশ নদী তীর সংরক্ষণ করার কর্মসূচী রয়েছে। দু’বছরের মেয়াদী এ কাজটি সম্পন্ন করতে সময় দেয়া হয় ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
কিন্তু ওয়েষ্টার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং শুরু থেকেই ঢিমে তালে কাজ করতে থাকে। সেইসাথে প্রতিষ্ঠানটি নানা অনিয়ম কারচুপিতেও জড়িয়ে পড়ে। সিডিউল বহির্ভূত নিম্নমানের ছোট আকারের পাথর, পাথরের পরিত্যক্ত ডাস্ট এবং স্থানীয় বালু দিয়ে সিসি ব্লক নির্মাণের কাজ শুরু করে। অথচ ব্লক নির্মাণে ১.৫ এফএম পরিমাপের বালু ব্যবহার করার কথা- যা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। পাটগ্রাম থেকে আনতে হয় এ বালু। ব্যয়বহুল ও ঝামেলা দায়েক হওয়ায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে তারা যমুনা নদী ও চরাঞ্চলের বালু ব্লক নির্মাণের কাজে ব্যবহার করে। এতে নদী তীরবর্তী সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ অভিযোগ তোলে। তাছাড়া কাজে ঢিলেমির কারণে পাউবো কর্তৃপক্ষ অসন্তষ্ট ছিলেন। ফলে এক পর্যায়ে তাদের কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ থেকে ১৯মে পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকে। এ সময় পর্যন্ত প্রকল্পটির কাজ হয়েছে মাত্র ৮% ভাগ।
পরবর্তীতে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং মূল ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ডক ইয়ার্ড এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ লিঃ এর সাথে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তাতে শর্ত থাকে ২০২০ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হবে। এজন্য একাধিক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজটি দ্রুত তুলে আনার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। সে অনুযায়ী ওয়েষ্টার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিংকে বাগুড়িয়া ও বালাসী পয়েন্টে এক হাজার ৬শ’ মিটার অংশ, ঢাকার ডিএমসি গ্লোবাল ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে কাতলামারী-সিংড়িয়া পয়েন্টের ৭শ’ মি. মাদারীপুরের এসএস ইঞ্জিনিয়ারিংকে রতনপুর পয়েন্টে এক হাজার ৫শ’ মি. এবং রাজশাহীর ফরিদ উদ্দিন ট্রেডার্সকে গজারিয়া গণ কবর পয়েন্টে ৭শ’ মিটার অংশে যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়।
কিন্তু এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে কাজের দায়িত্ব দেয়ার পরও প্রকল্পের কাজের তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। ফলে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিকবার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাইবান্ধা নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মোখলেছুর রহমান জানান, তাদের বিভিন্ন সময়ে তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও মোট কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৪০% ভাগ। কিন্তু পাউবোর অন্য একটি সুত্র জানায়, কাজের অগ্রগতির হার আরও কম। ওই সূত্রটি জানায়, এ পর্যন্ত ওয়েষ্টার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং বাগুড়িয়া ও বালাসী পয়েন্টে ৪২% ভাগ, ডিএমসি গ্লোবাল ইঞ্জিনিয়ারিং রতনপুর পয়েন্টে ৩৮% ভাগ, এসএস ইঞ্জিনিয়ারিং সিংড়িয়া-কাতলামারী পয়েন্টে ৪০% ভাগ এবং ফরিদ উদ্দিন ট্রেডার্স গণকবর পয়েন্টে কাজ করেছে মাত্র ৩০% ভাগ।
এদিকে চুক্তির শর্ত অনুযায়ি আগামী ৩০ জুন আসন্ন কাজের অগ্রগতি না হওয়ায় চুক্তি ভংগের কারণে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। তাই ওই ৪ প্রতিষ্ঠান পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং মূল ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ডক ইয়ার্ড এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের কাছে প্রকল্পের অবশিষ্ট কাজ শেষ করার জন্য আরও এক বছর সময় বর্ধিত করণের আবেদন করেছে। এব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন সিদ্ধান্ত এখনও পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে প্রকল্পের কাজে তদারকির জন্য মনিটরিং ব্যবস্থা তেমন ছিলো না বলে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী অভিযোগ করেছে। ফলে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ পয়েন্টে ফ্রি স্টাইলে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। নিম্নমানের পাথর, স্থানীয় চর এবং নদীর বালু ও পাথরের ডাস্ট ব্যবহার করে সিসি ব্লক তৈরী করা হয়েছে। স্থানীয় লোকজন জানান, এব্যাপারে গাইবান্ধায় পানি উন্নয়ন বোর্ডে অভিযোগ জানিয়েও কোন ফল পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট নদী তীরবর্তী এলাকার হাজার হাজার মানুষ আসন্ন বর্ষা নিয়ে এখন থেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। তাদের আশা ছিল জুনের মধ্যে কাজ শেষ হবে। ফলে নদী ভাঙনের হাত তেকে তাদের সম্পদ রক্ষা পাবে। কিন্তু তা না হওয়ায় তারা দুঃশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন।
সিংড়িয়া এলাকার বাসিন্দা হাসান আলী জানান, ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধটি মেরামতের অভাবে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। যমুনা নদী ভাঙন রোধ প্রকল্প শেষ না হওয়ায় আগামী বর্ষায় বন্যার পানিতে নদী ভাঙবেই। ফলে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধটি ছিঁড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। এতে ওই এলাকার হাজার হাজার জমির ফসল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নদী ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে শত শত পরিবার গৃহহারা হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
নদী তীরবর্তী অন্যান্য এলাকায় বসবাসকারী মানুষেরও একই ধরণের অভিযোগ। তাদের আশংকা হাজার হাজার পরিবার এবারো গৃহহারা হবে নদী ভাঙনের কারণে। যমুনা ভাঙন রোধ প্রকল্পটি তাই দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরী ছিলো।

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

নিউজটি শেয়ান করুন

© All Rights Reserved © 2019
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com