শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০১:২২ অপরাহ্ন

গাইবান্ধায় দ্বিতীয় দফা বন্যায় আবারও পানি বৃদ্ধি

গাইবান্ধায় দ্বিতীয় দফা বন্যায় আবারও পানি বৃদ্ধি

স্টাফ রিপোর্টারঃ উজান থেকে নেমে আসা পানি ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি পুনঃরায় বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। গত ২৪ ঘন্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি ১৪ সে.মি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৪৭ সে.মি এবং ঘাঘট নদীর পানি ৭ সে.মি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২৫ সে.মি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ইতোপূর্বে বন্যা কবলিত যে সমস্ত এলাকা থেকে পানি সরে গিয়েছিল সে সমস্ত এলাকাসহ নতুন নতুন এলাকায় পানি ঢুকে পড়েছে। এতে দ্বিতীয় দফায় বন্যায় মানুষের দূর্ভোগ আরও বেড়ে গেছে।
এদিকে সিভিল সার্জন ডাঃ এবিএম আবু হানিফ জানান, সাত উপজেলার ৫১টি ইউনিয়নের বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষের জন্য ১০৯টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। বন্যায় অনেক এলাকায় নানা ধরণের পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে চর্মরোগ, হাতে ও পায়ের আঙ্গুলে ঘা, এলার্জি, পানিতে চলাফেরার করার সময় পায়ে আঘাত, সাঁপে কামড়ানো।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এদিকে বন্যায় জেলার সাত উপজেলার ৫১টি ইউনিয়নের ৪২৪টি গ্রাম ও ২টি পৌরসভার ৫ লাখ ৮৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়েছে। ঘরবাড়ির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬৯ হাজার ৮৭০টি। তাদের বেশীর ভাগই নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে এসে উঠছে। আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে ১৯৭টি। এছাড়া ১৪ হাজার ২১ হেক্টর আউশ ধান, আমন বীজতলা, রোপিত আমন, পাট ও শাকসবজি বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে এবার বন্যায় ১টি গরু, ৩ হাজার ৭২০টি হাঁস-মুরগী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত জেলায় ১ হাজার ২৪৫ মে.টন চাল, ২১ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
কঞ্চিবাড়ী (সুন্দরগঞ্জ) থেকে আব্দুল মতিন সরকার জানান, গত সোমবার হতে অবিরাম বর্ষণ ও উজানের ঢলে ফের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পানি বেড়ে যাওয়ায় আবার পানিতে ভাসছে চরবাসী। সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তার চরাঞ্চলের বানভাসিদের মাঝে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। চাহিদার তুলনায় ত্রাণের বরাদ্দ অপ্রতুল। বন্যা শিবিরগুলোতে এখন ত্রাণ, ওষুধ, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্যের চাহিদা দেখা দিয়েছে। গত শুক্রবার রাত হতে পানি কমতে শুরু করলেও গত সোমবার রাত হতে আবার বাড়তে শুরু করেছে। বানভাসিদের মাঝে দেখা দিয়ে নানাবিধ রোগব্যধি, ত্রাণ ও গো-খাদ্য সংকট। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ সোলেমান আলী নিজে ওষুধ বিতরণ করছেন। প্রয়োজনের তুলনায় মেডিকেল টিমের সংখ্যা অনেক কম। সে কারণে বানভাসিরা ওষুধ পেতে বিলম্ব হচ্ছে। পর্যাপ্ত মেডিকেল টিম না থাকার কারণে এখনো অনেক দূর্গম চরাঞ্চলে বানভাসিদের কাছে ওষুধ পৌঁছেনি। বিশেষ করে পানি বিশুদ্ধ করন ট্যাবলেট ও গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ সোলেমান আলী জানান, পানিবন্দি পরিবারদের মাঝে শুকনো খাবার, ত্রাণ সামগ্রী, ওষুধ ও গো-খাদ্য বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। আরও ত্রাণ সামগ্রীর জন্য চাহিদা পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া মাত্রাই তা বিতরণ করা হবে।
বোনারপাড়া (সাঘাটা) থেকে আবু সাঈদ মন্ডল জানান, সাঘাটায় বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও গত মঙ্গলবার রাত থেকে আবার পানি বাড়তে শুরু করেছে। পানি বাড়ার সাথে সাথে দূর্ভোগ বাড়ছে বানভাসী মানুষদের। এখনও পানি বন্দি হয়ে আছে ১শ’ ২টি গ্রামের প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ। বন্যার্ত হাজার হাজার মানুষ ওয়াবদা বাঁধ, রেল লাইনের ধারে ও নব-নির্মিত উপজেলা কমপ্লেক্সে আশ্রয় কষ্টে দিনাতিপাত করছে। পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়েছে বন্যার্তদের মাঝে। হত দরিদ্রদের কাজ না থাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। চারিদিকে বন্যার পানি থাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট ব্যাপক হারে দেখা দিয়েছে। সেই সাথে অসুস্থ্য রোগীদের চিকিৎসা সামগ্রীর সংকটও দেখা দিয়েছে। বন্যার পানির তোড়ে ভেঙ্গে গেছে প্রায় ৫০ কি.মি কাচা ও ৬৬ কি.মি পাকা রাস্তা। কালভার্ট, ব্রীজ বিধ্বস্থ হয়েছে ২১টি। অপরদিকে ২৫ মিটার বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। ১শ’ ১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ৭শ’ ৯টি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সবক’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাময়িকভাবে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এই উপজেলায় সরকারীভাবে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে ৪৯টি। সাঘাটা উপজেলা সদর বোনারপাড়া থেকে জেলা সদরের যোগাযোগ চালু হলেও বোনারপাড়া থেকে মহিমাগঞ্জে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। তবে লালমনিরহাট-বোনারপাড়া-সান্তাহার সরাসরি রেল যোগাযোগ এখনও চালু হয়নি। বন্যার্তদের মাঝে ডাকাত ও সাপের আতংক বিরাজ করছে। উপজেলা ত্রাণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ত্রাণের ২শ’ ৪৮ মে.টন চাল ও ৮শ’ ৫০ মে.টন শুকনা খাদ্য বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। বোনারপাড়া ইউনিয়নের বাটি গ্রামের মল্লিকা বেগম জানান, আমার বাড়ীতে একবুক পানি, অন্যের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়ে অতি কষ্টে জীবন যাপন করছি। এ পর্যন্ত কোন সরকারী বা বেসরকারী সাহায্য আমার ভাগ্যে জোটে নি। আমি উপজেলা প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
গোবিন্দগঞ্জ থেকে ফারুক হোসেন জানান, গোবিন্দগঞ্জ আবারও বন্যার অবনতি ঘটেছে। গত ২৪ ঘন্টায় প্রবল বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি বেড়েছে। তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমা বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে। গত দুই দিনে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ১১২ মিলিমিটার। ফলে দুইদিন আগে বন্যা কবলিত যে সমস্ত এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছিল সেসব এলাকায় আবারও পানি বাড়তে শুরু করেছে। এতে দ্বিতীয় দফায় বন্যায় মানুষের দূর্ভোগ আরও বেড়েছে। বন্যায় গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভাসহ উপজেলার ১২ ইউনিয়ন পানিতে প্লাবিত হয়ে পরেছে। এতে প্রায় ৬ লাখ মানুষ বন্যা কবলিত। গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভা বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড এখন জলমগ্ন। এছাড়াও উপজেলার পৌরসভা, মহিমাগঞ্জ, শালমারা, শিবপুর, কোচাশহর, রাথালবুরুজ, দরবস্ত হরিরামপুর, ফুলবাড়ি, নাকাই, তালুককানুপুর, গুমানীগঞ্জ সহ ১২ টি ইউনিয়নের প্রায় ১২০টি বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় দুর্ভোগ লক্ষাধিক মানুষ দূভোগ পোহাচ্ছে। বন্যায় দুর্গত এলাকায় গবাদি পশুর খাদ্য সংকট, বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং স্যানিটেশন সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। কিছু কিছু বিদ্যালয়ের মাঠ ও শ্রেণী কক্ষে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় এবং কোথাও দুর্গত মানুষ আশ্রয় নেওয়ায় বিদ্যালয়ের পাঠদান প্রশাসনে নির্দেশে বন্ধ রয়েছে। বন্যা দুর্গত পরিবার গুলোকে সরকারি-বেসরকারি ভাবে ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তবে দুর্গত অনেক পরিবার এখনো ত্রাণ পায়নি বলে অভিযোগ করছে।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ প্রধান বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের বলেন এবারের বন্যায় উপজেলার পৌরসভাসহ ১১ ইউনিয়নের ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হয়ে পরেছে। বন্যা দুর্গত এলাকার প্রতিটি পরিবারের বাড়ি ঘরে পানি ওঠায় পরিবার গুলো চরম দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছে। বন্যার্ত মানুষের জন্য এ পর্যন্ত সরকারিভাবে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সরকারের নিকট আরো বরাদ্দ প্রদানের দাবি জানান তিনি। এছাড়াও বন্যা এলাকার মানুষ যেন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে না পরে সে জন্য ভ্রাম্যমান মেডিকেল টিমের তৎপরতা বৃদ্ধি করতে পবে। স্থানীয় জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের পাশে থেকে সেবা প্রদানের আহবান জানান। এ পর্যন্ত বন্যায় ৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
উপজেলা পরিবার ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মজিদুল ইসলাম জানান, বন্যা দূর্গত এলাকায় ১৭টি মেডিকেল কাজ করছে। এছাড়াও ৩টি মেডিকেল টিম সার্বক্ষনিক দায়িত্বে রাখা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার রামকৃষ্ণ বর্মন জানান, বন্যায় এ পর্যন্ত সরকারী ভাবে ৪৫ মেঃ টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও নগদ ১ লক্ষ টাকা যা দিয়ে শুকনো খাবার কিনে বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে।

Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!

নিউজটি শেয়ান করুন

© All Rights Reserved © 2019
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com