বৃহস্পতিবার, ১১ অগাস্ট ২০২২, ০২:০৪ পূর্বাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টারঃ উত্তরাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ সহজ করতে নেওয়া হয়েছিল একটি মেগা প্রকল্প। সেই লক্ষ্যে বালাসী-বাহাদুরাবাদ ঘাট রুটে ফেরি সার্ভিস চালু করতে নির্মাণ করা হয় নৌ-টার্মিনাল ও অন্যান্য অবকাঠামো। দুই দফায় প্রকল্পটির ব্যয় বাড়িয়ে ১৪৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা খরচ করে গত জুনে প্রকল্পটির কাজ শেষ হলেও বিআইডব্লিউটিএর প্রতিবেদনে জানানো হয়, এই পথ ফেরি চলাচলের উপযোগী নয়। এদিকে ফেরি সার্ভিসের পরিবর্তে গত ৯ মার্চ ফিটনেসবিহীন দুটি লঞ্চ সার্ভিসের উদ্বোধন করা হলে সেটিও এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফলে সরকারের এ মেগা প্রকল্প থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাচ্ছেন না এ অঞ্চলের মানুষ।
ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের বালাসীঘাট ও নদীর ওপারে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাটের মধ্যে ফেরি রুট চালু করতে দুই পাড়ে নির্মিত নৌ-টার্মিনাল ও নয়নাভিরাম অবকাঠামো এখন জনমানবহীন প্রান্তর-সদৃশ্য হয়ে আছে। এ প্রকল্পের আওতায় বাস টার্মিনাল, টোল আদায় বুথ, পুলিশ ব্যারাক, ফায়ার সার্ভিস, আধুনিক ডিজাইনের মসজিদ, খাবার হোটেল, আনসার ব্যারাকসহ বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণ করা হয়।
১৯৩৮ সালে তিস্তামুখ ঘাট ও বাহাদুরাবাদ ঘাট চালু হয়। এ দুই ঘাটে ফেরি সার্ভিসের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ চালু ছিল। যমুনা বহুমুখী সেতু চালু হওয়ার পর ২০০০ সাল থেকে এ রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে ঝুঁকিপূর্ণ পারাপার অব্যাহত ছিল।
এদিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর যানবাহনের চাপ কমাতে বিকল্প পথ তৈরি করার যুক্তি দেখিয়ে ২০১৪ সালে বালাসী ও বাহাদুরাবাদে ফেরিঘাট চালুর লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। ২০১৭ সালের অক্টোবরে একনেকের সভায় বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌরুটটি আবারও চালু করতে ফেরিঘাট নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। পরে প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ১৪৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা খরচ করে বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। বিআইডব্লিউটিএর কারিগরি কমিটি হঠাৎ করে নাব্য সংকট ও ২৬ কিলোমিটার বিশাল দূরত্বের নৌপথসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে নৌরুটটি চলাচলের অনুপযোগী বলে ঘোষণা করে।
এ প্রসঙ্গে উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শামছুল আলম সরকার বলেন, ১৯৯০ সালে নদীর নাব্য সংকটের অজুহাতে তিস্তামুখ ঘাটটি স্থানান্তর করা হয় একই উপজেলার উজানে বালাসীতে। নতুন করে সেখানেও প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয় করা। নির্মাণ করা হয় ত্রিমোহিনী রেলস্টেশন থেকে বালাসীঘাট পর্যন্ত নতুন প্রায় ৬ কিলোমিটার রেলপথ। সেখানেও কয়েক বছর চলার পর যমুনায় নাব্য হ্রাসের কারণে বালাসী-বাহাদুরাবাদ রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ অঞ্চলের মানুষজন শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ওমর ফারুক রনি বলেন, বালাসীঘাট থেকে নদীপথে ফেরি সার্ভিস চালু হলে এ এলাকায় বেকারত্ব আর থাকত না। ঘাটকে কেন্দ্র করে এই এলাকায় শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ হতো। এ প্রসঙ্গে ফুলছড়ি প্রেস ক্লাব সভাপতি আমিনুল হক জানান, এ রুটটি চালু হলে ঢাকার সঙ্গে উত্তরের আট জেলা ভ্রমণে দুই-তিন ঘণ্টা সময় কম লাগবে। ঢাকা-রংপুর জাতীয় মহাসড়ক ও যমুনা সেতুর ওপর চাপ কমবে।
লঞ্চ মালিক সমিতি সভাপতি মেহেদী হাসান বলেন, গত ৯ মার্চ প্রাথমিকভাবে লঞ্চ সার্ভিস চালু করা হলেও নাব্য সংকটের কারণে নদীপথে ডুবোচরে মাঝে মধ্যে লঞ্চ আটকা পড়ছে। এতে যাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়ছে। চারটি ড্রেজার মেশিন সব সময় নদী খননের কাজে নিয়োজিত থাকার কথা থাকলেও এখনও তা দেওয়া হয়নি। সামাজিক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর কবীর তনু বলেন, বালাসীতে ফেরিঘাট বাস্তবায়নের নামে গাইবান্ধার মানুষের সঙ্গে ভাঁওতাবাজি করা হয়েছে। ফেরির পরিবর্তে চালু করা হয়েছে ফিটনেসবিহীন লঞ্চ।
গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, রাষ্ট্রীয় ১৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প থেকে অর্থ লুট করা হয়েছে। এই লুটপাটের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিচার হোক। এ বিষয়ে ফুলছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিএম সেলিম পারভেজ বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই কাজ শুরু এবং শেষ পর্যায়ে এসে ফেরিঘাট প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্তে এ অঞ্চলের মানুষের উন্নয়নের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। চলতি বছরের ৯ মার্চ বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌরুটে লঞ্চ সার্ভিস চালু হলেও তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ কারণে সরকারের মেগা প্রকল্পও কাজে লাগল না উত্তরাঞ্চলের মানুষের।