বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০২:৩৭ অপরাহ্ন
ধাপেরহাট (সাদুল্লাপুর) প্রতিনিধিঃ সাংসারিক অভাব অনটন,অবহেলা, অনাদরে, বেশিদুর অগ্রসর হয়নি তাদের লুকায়িত প্রতিভা। পরিবর্তন হয়নি জীবন মান। এসকল গুনি সংঙ্গীত শিল্পিরা আজ মানবেতর জীবন যাপন করছে। কেই রাখেনা যাদের খবর। সাদুল্লাপুর উপজেলার ধাপেরহাট পালানপাড়া গ্রামের কয়েক অবহেলিত ক’জন যন্ত্র সংঙ্গীত শিল্পির দুঃখ দূর্দশা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে তাদের দ্বার প্রান্তে হাজির হয় দৈনিক ঘাঘট পত্রিকার প্রতিনিধি আমিনুল ইসলাম। তবলা বাদক মোহন কুমার সরকার (২৫) পিতা নকুল চন্দ্র সরকার, পেশায় একজন অসহায় দিন মজুর, এ ঘরে জন্ম নেয় মোহন, ছোট বেলা থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তবলা বাজিয়ে এলাকাবাসিকে তাক লাগিয়ে দেয় শিশু শিল্পি মোহন। আস্তে আস্তে তার প্রতিভা প্রচার হলে ২০০৮ সালে শিশু শিল্পি মোহন তবলা লহড়ায় বাদক হিসাবে রংপুর বেতার কেন্দ্রে তালিকাভূক্ত হয়। ২০১০ সালে রংপুর আর্টস একাডেমির স্বর্ণপদক প্রতিযোগিতায় তবলা বাজিয়ে ১ম স্থান দখল করেন তিনি। জাতীয় শিশু পুরুস্কার প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ শিশু একাডেমি রংপুর থেকে ‘খ’ বিভাগে তবলায় ১ম স্থান অধিকার করে পুরস্কারও তুলে নেন একই বছরে। সময়ের ব্যবধানে মোহন এখন হয়েছেন পেডিষ্ট। বড় বড় অনুষ্ঠানে প্যাড বাজিয়ে অনুষ্ঠান মাতিয়ে রাখলেও সংসার চলে অতিকষ্টে। বসত ভিটা নেই, নেই কোন নিজস্ব থাকার ঘর। ধাপেরহাট বন্দরে ছোট একটি রুম ভাড়া নিয়ে মা, বাবা ও বোনসহ কোন রকমে দিনাতিপাত করছেন তিনি। ভাগ্যে জোটেনি কোন সরকারী সুবিধা। একই গ্রামের আর এক নারী শিল্পি কুমারী নন্দিনী রানী বাঁশের বাশি বাজিয়ে এলাকা মাত করেছেন। সম্প্রতি বে-সরকারী টিভি চ্যানেল সময় টিভি সহ, সামাজিক গন যোগাযোগ মাধ্যমে তার প্রাণ জুড়ানো বাঁশির সুর ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। হতদরিদ্র পরিবারের কন্যা কুমারী নন্দিনী রানীর পিতা বিপ্লব চন্দ্র স্থানীয় মটর শ্রমিক সদস্য হিসাবে বাসষ্ট্যান্ডে চেইন মাস্টারের কাজ করেন। নন্দিনী স্থানীয় বি,এম,পি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী। লেখা পড়ার পাশাপাশি বাসা সংলগ্ন ধাপেরহাট দীপ শিখা সঙ্গীত নিকেতনে ওস্তাদ প্রদীপ কুমার বাবুলের নিকট বিগত ২ বছর থেকে বাঁশিতে তালিম নিচ্ছে নন্দিনী। সাংসারিক অবস্থা ভাল না হলেও বংশিবাদক নন্দিনীর স্বপ্ন, তিনি বড় হয়ে মিউজিক নিয়ে মাষ্টার্স করবে এবং বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা তার। মধুর বাঁশির সুর টিকিয়ে রাখতে আর নন্দিনীর মনের আশা পূরন করতে পারবে কি, তার অসহায় মা-বাবা? এ চিন্তা সর্বদা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাদের। অভাব অনটনে দিন চললেও নন্দিনীদের পরিবারের খোজ খবর কেউ রাখেনি। পায়নি কোন সরকারি সুযোগ সুবিধা সহায়তা। এমনি আরও একজন অসাহয় গরীব যন্ত্র সংঙ্গীত দোতারা বাদক নেপেন্দ্রনাথ সরকার (৬৮)। ছোট বেলা থেকেই দোতারা বাজানো আজ তার নেশায় পরিনত হয়েছে। একদিন দোতারা গান না বাজালে রাতে ঘুম হয়না তার। এই গুনী শিল্পির সাথে দেখা করতে গেলে তিনি তার বসবাস করা ভাঙ্গা ঘর হইতে দোতারা হাতে নিয়ে পা খুড়ে খুড়ে সামনে আসে এবং আদাব বিনিময় করেই বলে দোতারার বাঁজ শুনবেন বাবু,এক নাগারে দিনের পর দিন দোতারা বাজাতে বাজাতে তার ডান হাতের গীড়াই বাকা হয়েছে এবং পা দুটিই ফুলে গেছে। হাটতে কষ্ট হয় তার। প্রতিবন্ধী শরীর নিয়েই চলছে তার জীবন। সংসার জীবনে ৭ সন্তানের জনক সে, এক সময় এই গুণী শিল্পী স্থানীয় ধাপেরহাট বাস স্ট্যান্ডে কুলির কাজ করত। বয়সের ভারে এখন তিনি আর কুলির কাজ করতে পারেন না। ১৯৮৫ সাল থেকে রংপুর বেতার কেন্দ্রের তালিকা ভূক্ত শিল্পী হিসাবে মাসে ১দিন দোতারা বাজান । বর্তমানে সেখান থেকে সম্মানি পান মাত্র ২৫’শ টাকা। আধা ভাঙ্গা টিনের ছাউনি ঘরে তার বসবাস। সরকারি সুযোগ সুবিধা হিসাবে এ বছর পেয়েছেন বয়স্ক ভাতার কার্ড। এ ছাড়া তার কপালে জোটেনি অন্যকোন সরকারি সুযোগ সুবিধা। আরও বেশ কয়েকজন যন্ত্র পারদর্শী শিল্পীর বসবাস সাদুল্লাপুরের ধাপেরহাটে। ইতি মধ্যেই স্থানীয় দীপ শিখা সংঙ্গীত নিকেতন ও বি,এম,পি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেনির ছাত্র অন্তর মহন্ত, (বংশিবাদক) ও একই প্রতিষ্ঠানের ৮ম শ্রেণির ছাত্র বন্ধন সাহা বেহালা বাদক হিসাবে এবং দোতারায় খামারপাড়া গ্রামের হাফিজার রহমান (৫৫), বকশিগঞ্জ এলাকার আবু হোসেন রংপুর বেতারের শিল্পী হিসাবে তালিকা ভূক্ত হয়েছেন। যন্ত্র সঙ্গীত শিল্পীদের বিষয় নিয়ে কথা হয় ধাপেরহাট দীপ শিখা সঙ্গীত নিকেতনের পরিচালক, বাংলাদেশ শিল্পীকলা একাডেমি থেকে সনদপ্রাপ্ত বেহালা বাদক প্রদীপ কুমার বাবুলের সাথে: তিনি বলেন নিজের জীবনটা শেষ করলাম সঙ্গীত নিয়ে। কি পেলাম, কিইবা করতে পারলাম,আমাদের খবর কে রাখে? অনেক প্রতিভাবান শিল্পী রয়েছে আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা প্রান্তে, তাদের সরকারি পৃষ্টপোষকতা খুব প্রয়োজন।
দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া এসব গুণী শিল্পীদের খবর কেউ রাখেনা। সরকারি সহায়তা পেলে এসব শিল্পীরা তাদের যন্ত্র সঙ্গীতের প্রতিভায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশের সঙ্গীতাঙ্গণে সুনাম বয়ে আনবে। সরকারি ভাবে ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলে এসকল অবহেলিতা শিল্পীদের প্রতিভার বিকাশ অনুসন্ধান এখন সময়ের দাবি।